‘পথের পাঁচালী’ আর একজন সত্যজিৎ রায়ের গল্প…

0
899

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

সত্যজিৎ যখন তাঁর প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’ পরিচালনা করেন, তখন জানতেনই না ছবির কোনও স্ক্রিপ্ট হয়।

সত্যজিৎ রায়। নামটা বলার পর আর বোধহয় কিছুই বলার অপেক্ষা রাখে না। বাঙালির মনে শুধু নয়, গোটা গোটা বিশ্বের কাছে তিনি সমান সমাদৃত। বিশ্বের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে তাঁর নাম প্রথম সারিতে। ‘পথের পাঁচালী’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ থেকে  শেষ ছবি’আগুন্তুক’। যাত্রাপথটা মোটেই  মসৃণ ছিল না। সংগৃহীত ছবি ।

গোটা জীবনে তিনি ৩৫-এরও বেশি ছবি পরিচালনা করেছেন। সেই বিশ্ব বরেণ্য পরিচালকের আজ ১০০ তম জন্মদিন। ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্ম। পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, সাহিত্যিক, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার হিসেবে তিনি পরিচিত। তাছাড়া তাঁর লেখা বই-য়ের কথা আর নতুন করে বাঙালিকে বলে দিতে হবে না। তাঁর সাহিত্যিক মান তাঁর সমকালীন সময়ের কোনও প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের থেকে কম ছিল না। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায় তাঁর সমকালকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন। সত্যজিতের অমর সৃষ্টি ‘ফেলুদা’ তাঁর সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর বয়ে চলছে যুগে যুগে। সংগৃহীত ছবি ।

পথের পাঁচালী’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র জগতের যাত্রা শুরু। এরপর একে একে তান্রভ হাঁতে তৈরি হয়েছে পরশ পাথর , জলসাঘর, অপুর সংসার, অভিযান, মহানগর, কাপুরুষ ও মহাপুরুষ , নায়ক, গুপি গাইন বাঘা বাইন , অরণ্যের দিন রাত্রি, সীমাবদ্ধ, অশনি সংকেত, সোনার কেল্লা, জন অরণ্য, শতরঞ্জ কি খিলাড়ী, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, ঘরে বাইরে, গণ শত্রু, শাখা প্রশাখা এবং সর্বশেষ সৃষ্টি আগুন্তুক। সংগৃহীত ছবি ।

অসাধারণ সব চলচ্চিত্র নির্মাণ যেমন করেছেন, তার জন্যে হয়েছেন পুরস্কৃতও। তাঁর পুরস্কারের ঝুলি দেখে মনে হবে জাতীয় পুরস্কারের চেয়ে তিনি আন্তর্জাতিকভাবেই বেশী স্বীকৃত! আজীবন সম্মানস্বরূপ একাডেমি পুরস্কার (অস্কার) অর্জন ছাড়াও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছিলেন তিনি। যা তাঁর আগে একমাত্র মহান নির্মাতা ও অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনই পেয়েছিলেন। ফ্রান্সের সরকার ১৯৮৭ সালে তাঁকে সেদেশের বিশেষ সম্মনসূচক পুরস্কার ‘লেজিওঁ দ্য নর’ প্রদান করেন। ১৯৮৫ সালে অর্জন করেন ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেই ভারত সরকার তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন-এ ভূষিত করে। সেই বছরেই মৃত্যুর পরে তাঁকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। সংগৃহীত ছবি ।

সত্যজিৎ যখন তাঁর প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’ পরিচালনা করতে গিয়েছিলেন তখন তিনি জানতেন না ছবির জন্য আলাদা করে স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হয়। সেটে সবাই রেডি শ্যুটিংয়ের জন্য। সহ পরিচালক এসে তাঁর কাছে স্ক্রিপ্ট চাইলে তিনি বলেন, ‘স্ক্রিপ্টের কী দরকার? আমি যা বলব, ওঁরাও তাই বলবে। আলাদা করে স্ক্রিপ্টের কী দরকার?’ সবাই তো অবাক। তারপর তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে পেন আর কাগজ নিয়ে এস। আমি লিখে দিচ্ছি।’ সেই মতো তিনি ছোট কাগজের টুকরোতে একটা করে দৃশ্য এঁকে দিয়েছিলেন। সেখানেই লিখে দেন কে কি বলবে অর্থাৎ ডায়লগ। এই সবই হয়েছিল সেতে বসে শুটিং শুরুর ঠিক কিছুক্ষণ আগেই। এই চিরকূটগুলোই ছিল ‘পথের পাঁচালী’র স্ক্রিপ্ট। যা থেকেই স্পষ্ট তিনি ছিলেন কালজয়ী পরিচালক। তাঁর ছবির প্রতিটি বিষয় থাকত তাঁর নখদর্পণে। মাথায় এমনভাবে গেঁথে থাকত লেখার দরকার পড়ত না। সংগৃহীত ছবি।

তবে সত্যজিৎ রায় কুরোসাওয়ার ছবি পছন্দ করতেন। তাঁর ছবি সত্যজিৎকে উৎসাহিত করত। তাঁর বহু ছবি  কুরোসাওয়ার ছবি দেখে অনুপ্রাণিত। সংগৃহীত ছবি ।

স্বাধীনতার পরে যখন দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার সময়, তখন চলচ্চিত্র পরিচালকদের পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও ইন্দিরা গান্ধি। শোনা যায় তাঁরা  দু’জনেই ছিলেন চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষক।  পাশাপাশি ভারতীয় পরিচালকদের বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে প্রভূত উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁরা। ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরামর্শদাতা মারি সিটন ছিলেন নেহেরু পরিবারের বন্ধু। রুশ কিংবদন্তি পরিচালক সের্গেই আইজেনস্টাইনের জীবনী লেখার পরেই নেহেরু পরিবারের আমন্ত্রণে তিনি ভারতে আসেন। সংগৃহীত ছবি ।

সিটনের সহায়তায় সরকারী চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রচারই ছিল তাঁকে এদেশে আমন্ত্রণ জানানোর মূল উদ্দেশ্য। অনেকেই হয়তো জানেন না, ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বিশ্বের দরবারে ভারতীয় শিল্পকলাকে তুলে ধরতে অত্যন্ত উত্‍সাহী ছিলেন। ১৯৫৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পথের পাঁচালী’-র সূত্র ধরেই সত্যজিত্‍ রায় ও তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পারেন ইন্দিরা গান্ধি। মারি সিটন-ও ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন ছবির। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে নিও-রিয়্যালিজমের সূত্রপাত ‘পথের পাঁচালী’র হ্যাট ধরে। জানা যায়, নেহেরু পরিবারকে এই ছবি সম্পর্কে এমনটাই জানিয়েছিলেন সিটন নিজে। সংগৃহীত ছবি।

সত্যজিতের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী ও মারি সিটনের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। মারি সিটন ‘পথের পাঁচালী’-র প্রসঙ্গে জানার পরে কলকাতায় আসেন এবং কলকাতা ফিল্ম সোসাইটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে উদ্যোগী হন। ওই সোসাইটি ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও, পঞ্চাশের দশকের শুরুতে এই সোসাইটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বেশিরভাগ সদস্যই তখন নিজের নিজের ছবির কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। মারি সিটন দীর্ঘ সময় কলকাতায় থাকেন এবং ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা সত্যজিতের জীবনীগ্রন্থ- ‘পোর্ট্রেট অফ আ ডিরেক্টর- সত্যজিত্‍ রে’। সংগৃহীত ছবি ।