হায়রে চলচ্চিত্র ! বাহারে চলচ্চিত্র !!

0
777

আনিফা আরশি:

-সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র সাতকাহন-

“চলচ্চিত্র শিল্প” বলতে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে গল্প চিত্রনাট্য সংলাপ শিল্পীকলাকুশলী সুটিং পোস্ট-প্রডাকশন, সঙ্গীত রেকর্ডিং সহ সংশ্লিষ্ট সকলের অংশীদারিত্বে নির্মিত চলচ্চিত্র এবং পরিবেশনার প্রচার-মাধ্যম সার্ভার-সার্ভিস কোম্পানিসহ প্রদর্শক বা প্রেক্ষাগৃহকেই বোঝানো হয়। এর মাঝে রয়েছে সরকারের কিছু মাননীয় বিধিবিধান (চলচ্চিত্রের কপিরাইট রেজিসেট্রশন ও সনদপত্র) সমূহ। অতঃপর রয়েছে চলচ্চিত্র দর্শক।

চলচ্চিত্রের আপাতত পাঁচটি পক্ষ বা ক্ষেত্র রয়েছে। এক, চলচ্চিত্র উৎপাদন ও পরিবেশনা। দুই, চলচ্চিত্র পরিবেশনায় প্রেক্ষাগৃহ। তিন, সরকারের মাননীয় বিধিবিধান ও সহযোগিতা। চার, বিকল্পধারা চলচ্চিত্র ক্ষেত্র। পাঁচ, চলচ্চিত্র দর্শক।

চলচ্চিত্রের সকল যুগেই এই পক্ষ সমূহের মাঝে রয়েছে নানান অভিযোগের পালাবদল। কখনও বা তা আবার প্রকট আকার ধারণ করে। যখন চলচ্চিত্র শিল্পের স্বর্ণযুগ তখন অভিযোগের পালাবদল অনেক কমই দেখা যেত। চলচ্চিত্র শিল্পের যে কোন সংকটকালীন সময় এই অভিযোগ ও সমন্বয়হীনতা আরো জটিল রূপ ধারণ করে। আর তখনই সংকটকে মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

চলচ্চিত্রের ইতিহাসে না গিয়ে চলচ্চিত্রের সংকটকালীন সময়কে নিয়ে বলি, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অর্থাৎ ২০০১ সাল থেকেই মূলত চলচ্চিত্র সংকটের বলয়ে প্রবেশ করে। ছয় বছর টানা অশ্লীল চলচ্চিত্র দেশের ১২শত প্রেক্ষাগৃহের ও দর্শকদের নৈতিকতার ক্ষতি সাধিত করে। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হতে হতে আজ দেড়শতে এসে ঠেকেছে, একই সাথে পারিবারিক দর্শক বিমুখ হয়ে পড়ে।

২০০৭-০৮ সালের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই অশ্লীল চলচ্চিত্র বন্ধ করতে সক্ষম হয়। বিধি বাম হিসাবে ২০০৯-১০ হতেই দর্শকদের ঘরে বসে ইন্টারনেট মাধ্যমে ইউটিউবসহ বিভিন্ন স্কাইনেট টিভিতে সহজেই বিশ্ব-চলচ্চিত্র দেখার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। পাশাপাশি শুরু হয় এক শতাব্দীর চলচ্চিত্রের প্রযুক্তির পালাবদল। ৩৫ মি,মি, সেলুলয়েডের চলচ্চিত্র পরিস্ফুটন ও মুদ্রণ জটিলতা থেকে বের হয়ে সহজ পদ্ধতি ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে নির্মাণ ও প্রদর্শন উভয় ক্ষেত্রেই এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ইলেকট্রনিক ক্যামেরায় সুটিং ও পোস্ট-প্রডাকশন এবং ইলেকট্রনিক প্রজেকশনে প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন।

চলচ্চিত্রের এই প্রযুক্তিগত ট্রানজেকশন পিরিয়ড ২০১০ থেকে এখনও চলছে। আবার ডিজিটাল বা ইলেক্ট্রনিক চলচ্চিত্র নির্মাণের মানগত ঠিক নেই। স্বল্প সংখ্যক ২কে রেজুলেশনে নির্মিত হচ্ছে বটে। অথচ ২কে রেজুলেশনের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য যে দেড়শত সিনেমা হল রয়েছে তার ৯৫% ভাগ সিনেমা হলের সেই প্রজেক্টর নেই, নেই ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম। শুধুমাত্র সিনেপ্লেক্স গুলোতে রয়েছে। এই সিনেপ্লেক্স ঢাকার পাঁচ-ছয়টিসহ দেশে মোট দশবারোটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্র।

গুণগত মানের কারণে দর্শক একটি সিনেমা যথার্থভাবে উপভোগে বঞ্চিত হচ্ছে। এই ট্রানজেকশন পিরিয়ড আরো কতকাল চলবে তা নির্ভর করছে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠনের সাংগঠনিক কার্যক্রমের উপর। সকল সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এতোটাই প্রকট যে সংকটকালীন সময় উত্তরণের সকল উদ্যোগ ধাপে ধাপে স্তিমিত হয়ে পড়ছে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগতো রয়েছেই। সরকারও সংগঠন গুলোর এই অবস্থা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।

চলচ্চিত্র পরিবেশনের প্রধান আয়ের ক্ষেত্র হচ্ছে প্রেক্ষাগৃহ। এখন অবশ্য ইউটিউব রাইটস টিভি রাইটস এবং অন্যান্য নেট ভিত্তিক বিভিন্ন মাধ্যমে এবং ওভারসিজ মার্কেটিং এও ভালো আয়ের ব্যবস্থা বা বাজার তৈরী হয়েছে। এমনিভাবেই প্রেক্ষাগৃহের প্রাধান্যতা কমে আসছে। প্রদর্শকরা হল বন্ধ করার ঘোষণা দিচ্ছে যে তাদের পক্ষে প্রদর্শন ব্যবসা আর লাভজনক নয়। এবং তাই হচ্ছে।

কিন্তু প্রদর্শকরা স্বীকারই করে না যে তাদের মান্ধাতা আমলের প্রেক্ষাগৃহ এখন অচল। এমনকি যে এলাকায় তার প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে তা আর যথার্থ দর্শকদের যাওয়ার ক্ষেত্র নয়। শহরের নতুন নতুন বানিজ্যিক ও বিনোদন এলাকা তৈরী হয়েছে। সেই সকল এলাকায় বরং দর্শক সৃষ্টি বা বিদ্যমান রয়েছে। তাই আমাদের নতুন প্রদর্শক সৃষ্টি করতে হবে। চলচ্চিত্রের উত্তরণের বৃহত্তর স্বার্থে।

দেশের সকল জেলা উপজেলা সদরের বানিজ্যিক সংগঠনের সাথে সিনেপ্লেক্স এর প্রজেক্ট প্রোফাইল নিয়ে বসতে হবে। তাদের সিনেপ্লেক্স এর ফিটবেক বোঝাতে হবে। তাদেরকে প্রদর্শক করার যাবতীয় কর্মযজ্ঞ অতিদ্রুত শুরু করতে হবে। উপযোগিতার অভাবে দেশের সকল সিঙ্গেল স্ক্রিনিং সিনেমা হল গুলোকে পরিত্যক্ত করে দিতে হবে। এবং একাধিক স্ক্রিনিং সিনেপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। অবশ্যই সরকার বেসরকারি উদ্যোগকে যথাযথ সহযোগিতা করবে।

এই ট্রানজেকশন পিরিয়ড অতি প্রয়োজনে, আগামী পাঁচ বছর মেয়াদে দ্রুত কার্যক্রমের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে হবে।
ফলে প্রেক্ষাগৃহ হতে চলচ্চিত্র প্রযোজকগণ আবার সর্বাধিক আয়ের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে। দর্শকরা সিনেপ্লেক্স এ চলচ্চিত্র যথার্থ উপভোগে সক্ষম ও বিনোদিত হবে।

মূলত চলচ্চিত্র উত্তরণের অন্যতম পথ কিন্তু এই একটাই। বিশ্ব চলচ্চিত্র শিল্প এখন এই সিনেপ্লেক্স এর বিপ্লবেই উত্তরণে ও বানিজ্যিক সফলতা অর্জন করে যাছে। পাশাপাশি ইনটারনেট মিডিয়াতো রয়েছেই। চলচ্চিত্র সিনেপ্লেক্স গুলোতে দর্শনের মূলমন্ত্র হচ্ছে সুন্দর পরিবেশ, শ্রবণে ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম এবং দর্শনে দর্শকদের আই-ভিউ থেকে ১০০ হতে ১২০ ডিগ্রি এঙ্গেলে চলচ্চিত্র উপভোগের চমক, যা অন্য কোন মাধ্যমেই সম্ভবপর নয়।

উপরে উল্লিখিত পাঁচটি চলচ্চিত্র ক্ষেত্র বা পক্ষ সমূহের লক্ষ্য ও প্রতিপাদ্য একই। প্রত্যেকের স্বার্থও আজ অভিন্ন তাই জনপ্রিয় চলচ্চিত্র (পপুলার ফিল্ম) এবং শৈল্পিক চলচ্চিত্র (আর্ট ফিল্ম) সংশ্লিষ্টজনেরা দেশজ চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ও সংকটকালীন সময় হতে উত্তরণে ঐক্যবদ্ধের বিকল্প নেই। সকলকে এক বিন্দুতে উপনীত হতে হবে। তবেই হায়রে চলচ্চিত্র হতে বাহারে চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠায় আমরা সফল হবো।

লেখক: জাহিদ হোসেন
চলচ্চিত্র পরিচালক,কার্যকরী সদস্য
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি।