দেশি সংস্কৃতি কে বাঁচাবে চলচ্চিত্র? নাটক? নাকি ওয়েব সিরিজ?

0
988

আনিফা আরশি:
-সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র সাতকাহন-

আমাদের বঙ্গভূমিতে তথা বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্প মাধ্যমের বয়স একশত বছরেরও বেশী। নাটক (টেলিভিশনের জন্য পিটিভি ও পরবর্তীতে বিটিভিসহ প্রাইভেট প্রডাকশন) এর বয়স প্রায় ষাট বছর ধরে সময়ে সময়ে তৈরী হয়ে আসছে। ওয়েব সিরিজের বয়স মাত্র তিন বছরের মত।

চলচ্চিত্রের জন্য রয়েছে সেন্সর বোর্ড, এই বোর্ড কর্তৃক ছাড়পত্র পাওয়ার পর তা দর্শকদের মাঝে প্রদর্শনের জন্য বৈধতা অর্জন করে। আর টেলিভিশনের জন্য ছিল এবং আছে টিভি কর্তৃপক্ষ বা কোম্পানীর নিজস্ব সেন্সর বোর্ড বা কমিটি যা সরকারের প্রচারের নীতিমালা মেনে চলে।

অন্যদিকে সদ্য আবিষ্কৃত নতুন মাধ্যম বলে প্রচলিত ইন্টারনেট নির্ভর স্ট্রিমিং পোর্টাল এর কিছু প্রডাকশন কোম্পানি তাদের ক্ষেত্র থেকে বলা যায় স্বাধীনভাবেই যে কোন প্রডাকশন (নাটক, টেলিফিল্ম, চলচ্চিত্র বা আজকের কথিত ওয়েব সিরিজ) সেন্সর ছাড়পত্র ব্যতিরেখে নিয়মিত প্রচার করতে পারছেন।

ফলে চলচ্চিত্র ও টিভি মাধ্যমের রয়েছে সরকারের নীতিমালার অনুসরণে নির্মিত প্রডাকশন। আর অন্যদিকে ইন্টারনেট নির্ভর স্ট্রিমিং পোর্টাল এর অবাধ ও স্বাধীন প্রডাকশন, উভয় প্রডাকশনের প্রদর্শনেরই লক্ষ্য কিন্তু দর্শক। এবং বানিজ্য ও খ্যাতি অর্জন।

সেন্সর বিহীন যে কোন প্রডাক্শনের উপর সহসাই দর্শকদের মানসিকভাবে আকর্ষণ বা মোহ কাজ করে। এই আকর্ষণের দুটি প্রধান বিষয় রয়েছে এক সামাজ, অর্থাৎ সমাজের অনেক বিষয়ের মাঝে অবক্ষয় সন্ত্রাস উগ্রতা ব্যাভিচার ও যৌনতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ বিষয় গুলো সিনে প্রডাকশনে প্রকাশ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রা বজায় রাখার পক্ষপাতী সরকার কর্তৃপক্ষ।

দুই, রাজনীতি ও জনপ্রশাসন, অর্থাৎ রাজনীতির উপর সমাজ প্রভাবিত হয়ে থাকে। ফলে রাজনীতি ও প্রশাসনের অনেক বিষয়, যেমন ক্ষমতা সেবা আইনকানুন ও জনকল্যাণমূলক সেবা কাজে সরকার ও রাষ্ট্রের প্রশাসন সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে থাকে। এ বিষয় গুলোর বিভিন্ন নেতিবাচকদিক সরাসরি স্বাধীনভাবে সিনে প্রডাকশনে প্রকাশিত হলে, সরকার মনে করে সমাজে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং দেশ-সমাজ অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। তাই প্রডাকশন গুলোর যেন এমন কোন বিষয় না থাকে যা সরকারের এবং সমাজের সেবায় প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় সরকারের ও বেসরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়, কিবা কোন রাজনীতিতে কোন অস্থিতিশীলতার পরিবেশের সৃষ্টি না হয়।

বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র আছে। যেখানে জনসাধারণের কাছে দেশ সমাজ ও রাজনীতির বিষয়ের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে নির্মিত প্রডাকশন যেকোন মাধ্যমে প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু আমাদের এই ভূমির মানুষের কাছে রাজনীতি সমাজনীতি ও ধর্মনীতির স্বাধীনতায় এতসব জটিলতা রয়েছে যে, যে কোন সরকারের কাছেই তা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ফলে সরকার নিয়ন্ত্রণ বলেন কিবা সেন্সর বলেন, এটি প্রয়োগ করে একটি স্থিতিশীল সমাজ, রাজনীতি ও ধর্মীয় সহাবস্থানের বিশ্বাসী।

এখন আসি, মিডিয়ার অধিকাংশ মানুষই দুইভাগে বিভক্ত। এক, চলচ্চিত্র শিল্প মাধ্যম। দুই, টিভি প্রডাকশন শিল্প মাধ্যম। এই দুই মাধ্যমের শিল্পজন হতেই সৃষ্ট আজকের ইন্টারনেট নির্ভর স্ট্রিমিং পোর্টালের জন্য উৎপাদিত ওয়েব সিরিজ। যদি এই মাধ্যম অবাধে প্রচারের সুযোগ পায়, তাহলে নিশ্চিত উপরের উল্লেখিত দুটি শিল্প মাধ্যমই সম্পূর্ণ ধ্বংস বা বন্ধ হয়ে পড়বে। হয়তো সরকার তার নিজস্ব কিছু প্রডাকশনের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাবে। সিনেমাহল এবং টিভি মাধ্যম গুলো বেসরকারি উদ্যোগের কোন চলচ্চিত্র বা নাটক এর নতুন প্রডাকশন আর পাবে না।

দেশের অধিকাংশ দর্শকরাই ইন্টারনেট নির্ভর স্ট্রিমিং পোর্টাল এর প্রডাকশনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যেভাবে এখানে দর্শকদের সমাগম ঘটছে প্রতিদিন। এখনই এই মাধ্যমে খুবই ভাল ব্যবসা তৈরী হয়েছে। অহেতুক চলচ্চিত্র ও টিভি প্রডাকশন তৈরী করে আবার সেন্সর করার জটিলতার কী দরকার ?! চলচ্চিত্র ও টিভি শিল্প সংশ্লিষ্ট মাধ্যমের সকল প্রযোজক পরিচালক শিল্পী কলাকুশলীরা প্রস্তুত রয়েছে (চলচ্চিত্র ও টিভি মাধ্যমের) সেন্সরের ঝামেলা এড়াতে বা তোয়াক্কা না করে সরাসরি সেন্সর বিহীন “ওয়েব সিরিজ” প্রডাকশন তৈরীতে। সরকার কী সেই সুযোগ দিচ্ছেন ?!?

গত তিন বছর ধরে অবাধে যে “ওয়েব সিরিজ” তৈরী হয়েছে বা হচ্ছে, সেই মিছিলে সকলে সামিল হলে সরকার কী আর কোন সেন্সরেড প্রডাকশনের মিডিয়ার মানুষ খুঁজে পাবেন ?!? আমারতো মনে হয় একজনও পাবেন না। সরকারের মৌনতা বা নীরবতা কী সকলকে সেদিকেই ধাবিত করছে ?! যদিও একজন আইনজীবী বাদী হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে রীট করেছেন এবং আদালত সকল ইন্টারনেট স্ট্রিমিং পোর্টালের প্রডাকশন প্রদর্শন সরকারকে বন্ধ করার আদেশ জারি করেছেন।

তথ্যমন্ত্রণালয়ের কাছে এর সার্বিক সমাধান বা সিদ্ধান্ত পেতে কতদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ? এ শিল্প মাধ্যমের সংশ্লিষ্ট কেউ কিছু নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। এমনিতেই চলচ্চিত্র ও নাটক শিল্পমাধ্যমের সংশ্লিষ্টজনেরা করোনা সংক্রান্ত বৈশ্বিক মহামারীর কবলে গৃহবন্দি। এবং সকল প্রডাকশনও বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে সিনেমা হল গুলোও।

সরকারের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ছাড়া বৃহত্তর এই দুই মাধ্যমের সংশ্লিষ্টজনেরা কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছেন না। এমন ক্রান্তিকাল পূর্বে কখনও দেখা যায়নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্রের বহু অমীমাংসিত সরকারের এবং চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সিদ্ধান্ত পড়ে রয়েছে, যে কারণে টিভি প্রডাক্শন শিল্পের চেয়ে চলচ্চিত্র শিল্পের আজ অচল অবস্থা। এর মাঝে “ওয়েব সিরিজ” মাধ্যম চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য ভয়াবহ নেতিবাচক, যা এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই চলচ্চিত্র শিল্পের চাঁকা থামিয়ে দিতে সক্ষম।

লেখক: জাহিদ হোসেন
চলচ্চিত্র পরিচালক,কার্যকরী সদস্য
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি।