কেমন আছেন দুই দশক আগে অভিনয় ছাড়া নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী শিল্পী

0
992

৯০ এর দশকে সিনেমায় অভিষেক। এর পর টানা সাফল্য। তার পর হঠাৎ করেই আবার উধাও হয়ে যাওয়া। সবই যেন একটা যোগ সূত্র স্থাপন করে। বলছিলাম অভিনেত্রী শিল্পীর কথা। যিনি ৯০ এর দশকে বাংলাদেশি সিনেমা প্রেমীদের উপহার দিয়েছেন অসংখ্যা জনপ্রিয় হিট সিনেমা। কাজ করেছেন দেশের সব বড় বড় তারকা অভিনেতাদের সঙ্গে। তবে রূপালি এই জগৎটি ছেড়ে দিয়েছেন আজ থেকে দুই দশক আগে। এত বছর কেটে গেছে, তবু এখনো ’প্রিয়জন’ ছবির অভিনেত্রীকে খোঁজেন দর্শকেরা। কেন অভিনয় ছাড়লেন, কেন সিনেমাকে বিদায় জানালেন, কেন অনেকে ফিরলেও তাঁর ফেরা হলো না—এমন প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয় সিনেমা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

’সিনেমা ছাড়ার কারণ ছিল অশ্লীলতা। অভিনয়ের শুরুতে আমরা যেভাবে কাজ করছিলাম, পরে সেভাবে কাজ করতে পারছিলাম না। পরিবেশটা বদলে গিয়েছিল। তখনকার ফিল্মের সঙ্গে তাল মেলাতে পারিনি একদম’—অকপটে জানালেন নব্বই দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা শিল্পী।

পরে সিনেমার হাওয়া পাল্টাতে থাকে। সুবাতাস আসে সিনেমায়। অশ্লীলতা সরে যায়। এরপরও কেন ফিরে আসেননি? শিল্পী বললেন, ’আমার আর নতুন করে স্ট্রাগল করতে ইচ্ছে করেনি। আমাদের সময় এক বছরে প্রচুর ছবি নির্মাণ হত। এটা পরে কমে যায়। মান্না ভাই মারা যাওয়ার পর নায়ক বলতে শুধু শাকিব খান। শাকিব খান একা কতজন নায়িকার সঙ্গে ছবি করবে?’

একই সঙ্গে শিল্পী অনুভব করেন, তাঁর জন্য তেমন চরিত্র সিনেমায় নেই। ’আমাদের জন্য যে রকম চরিত্র হওয়া দরকার সে রকমটা হয় না এখানে। পাশের দেশ ভারতে একটা ছবিতে করার মতো অনেক চরিত্র থাকে। আমাদের দেশে শুধু নায়ক-নায়িকাকেন্দ্রিক ছবি হয়। এ ধরনের ছবিতে আমার মতো অভিনেত্রীর জন্য কোনো চরিত্র থাকে না’—আক্ষেপ শিল্পীর গলায়।

পরিস্থিতি অনুকূলে এলেও তাই শিল্পী আর সিনেমার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি।
পাঁচ বছরে ৩৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এগুলোকেই আঁকড়ে ধরে বাকি জীবন বাঁচতে চেয়েছেন। শিল্পী বললেন, ’আমি মনে করিনি সিনেমা আমাকে করতেই হবে। যা ছবি হাতে পেলাম তাই করলাম, এ রকম করিনি আমি। আমি যে অবস্থানে ছিলাম, যতটুকু সম্মান পেয়েছিলাম, যেনতেন কাজ করে সেই জায়গাটুকু আমি হারাতে চাইনি। আমি চাইনি আমার শ্রেষ্ঠ সময়টুকু মুছে যাক। সময়টাকে একই জায়গাতে আটকে রাখতে চেয়েছি আমি।’

সিনেমায় আর না ফিরলেও টিভি মিডিয়াতে কিছুদিন কাজ করেছেন শিল্পী। বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেছেন। বাংলাভিশনে ’ফিল্মবিট’ নামে একটা গানের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন কয়েক বছর। সেই সময় বিয়ের পিঁড়িতে বসেন শিল্পী। এরপর ধীরে ধীরে সংসারের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। ২০১১ সালে ব্যবসায়ী আলমগীর ইকবালকে ভালোবেসে বিয়ে করেন শিল্পী। ২০১২ সালের প্রথম সন্তান জন্মের সময় চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর আর মিডিয়ামুখো হননি।

শিল্পী বললেন, ’তখন সিনেমায় টিকে থাকতে হলে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হতো। আমার পরিবারে কোনো হাহাকার ছিল না। এখনো তেমন চাহিদা নেই। যে জন্য আমাকে অভিনয় করতেই হবে—এমন কোনো কথা নেই। আমার পরিবারে কেউ কখনো অভিনয় করেনি। আমিও এসেছি হুট করে। যেভাবে এসেছি, একদিন সেভাবেই চট করে সরে গেছি।’

শিল্পীর বাবার বাড়ি ভারতে। মায়ের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। তিনি বড় হয়েছেন ঢাকায়। সিনেমায় আসার কোনো ইচ্ছে, স্বপ্ন, পরিকল্পনা কিছুই ছিল না। স্কুলে পড়ার সময় ভাইয়ের বন্ধুদের পরামর্শে মডেলিং করার ভাবনা আসে মাথায়। তাঁর এক মামা শিল্পীকে বললেন, তুই কি মডেলিং করবি? আগে অভিনয় শেখো। মামা তাঁকে ভর্তি করে দিলেন নারায়ণগঞ্জের থিয়েটারে। কীভাবে যেন সিনেমার লোকের কানে চলে গেল শিল্পীর নাম। তাঁর কাছে সিনেমার প্রস্তাব আসতে থাকল। তাঁর মায়ের ইচ্ছা ছিল শিল্পী অভিনয় করুক।

শিল্পী সেই সময়ের স্মৃতি টানলেন, ’প্রথম ছবি রিলিজের আগেই আমি সাত–আটটি ছবি সাইন করি। প্রথম সাইন করি আওলাদ হোসেনের “নাগ-নর্তকী”। এটা একটা সাপের ছবি। তারপর সাইন করি জামশেদুর রহমানের “লাভ-লেটার”। এটা একটা রোমান্টিক ছবি। “বাংলার কমান্ডো” রিলিজ হয় প্রথমে।’ এতে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন বাপ্পারাজ, আমিন খান ও হুমায়ুন ফরীদি।

সেই সময়ের অনুভূতিগুলো কি এখনো তাজা শিল্পীর মনে? ’তখন কাজটা খুবই এনজয় করতাম। আমরা স্বর্ণযুগে এসেছি। এখন এফডিসিতে গেলে মন কাঁদে। একদিনের ঘটনা বলতে পারি। বোটানিক্যাল গার্ডেনে শুটিং করতে গিয়েছি। হাজার হাজার মানুষ। এত লোকের মধ্যে আবার সেদিন প্রচণ্ড গরম। একপর্যায়ে আমি মাটিতে শুয়ে পড়ি। মাকে বললাম, আমাকে দিয়ে ফিল্ম হবে না’, হাসলেন শিল্পী।

’আসলে মানুষ পারে না দুনিয়াতে এমন কাজ নেই। এখন ভাবলে অবাক লাগে, সেই আমি কীভাবে ৩৫টা ছবি করে ফেলি। আপনারা জানেন, ফিল্মের কাজ মাটি কাটার মতো কঠিন। রোদের মধ্যে ব্লেজার পরতে হয়। শীতের দিনে পাতলা কাপড়ে কাজ করতে হয়। অনেক দিন সারাবেলা না খেয়ে থাকতে হয়। এখন যখন সেসব দিনের কথা ভাবি খুব অদ্ভুত লাগে’, গলাটা নরম হয়ে এল শিল্পীর।

নিজের অভিনীত প্রিয় ছবির কথা জানতে চাইলে শিল্পী জানালেন, ’বাবা কেন চাকর’, ’লাভ-লেটার’, ’সুজনবন্ধু’ ও ’প্রিয়জন’–এর কথা। এতগুলো ছবিতে করেছেন, অথচ মাত্র একটা ছবি ’প্রিয়জন’ দিয়ে দর্শকেরা তাঁকে মনে করেন, সালমানের নায়িকা বলে তাঁকে ডাকেন, এতে তাঁর কোনো খারাপলাগা কাজ করে কি? এ প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ’খারাপ লাগবে কেন? অবশ্যই ভালো লাগে। “প্রিয়জন”–এর কথা অনেকে বলেন। অনেকে বলেন “বাবা কেন চাকর” ছবির কথা। একটা ছবিতে আমি কালো মেয়ের চরিত্র করি। ওটার কথাও বলেন অনেকে।’

’সালমান আমার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল। তার নায়িকা বললে আমার খারাপ লাগে না। এ দেশের অনেক নায়কের চেয়ে সালমান জনপ্রিয় ছিল। জানি না মারা গেছে বলে এত জনপ্রিয়তা কি না, তাই-বা বলি কী করে, জীবিত অবস্থায়ও ও ছিল অনেক জনপ্রিয়। ও মানুষটাই এত বিনয়ী, এত ভদ্র, এত মেধাবী ছিল যে বলার মতো নয়’—সালমান প্রসঙ্গে বললেন শিল্পী।

সিনেমায় কখনো ফেরার ইচ্ছে নেই শিল্পীর। একমাত্র ছেলে সানাত ইকবাল আর একমাত্র মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনা ইকবালই নিয়ে এখন তাঁর গোটা ভুবন। স্বামী-সংসার ফেলে অভিনয়ে ফিরতে চান না আর। শিল্পী জানালেন, অভিনয়ের অনেক প্রস্তাব আসে তাঁর কাছে। ’সিনেমায় কাজের ধারাই এমন যে সকাল আটটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ চলে। আমার বাচ্চারা স্কুলে যায়। ওদের রেখে আমি কাজ করতে পারবো না’—সোজা বলে দিলেন শিল্পী।

১৯্৯৫ সালে ’বাংলার কমান্ডো’ সিনেমার মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচিত্র অঙ্গনে আবির্ভাব তার। এর পর থেকেই আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। কাজ করেছেন কালজ্বয়ী সব সিনেমাতে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি সিনেমার নাম হচ্ছে,’প্রিয়জন’, ’বাবা কেন চাকর’, ’শেষ প্রতীক্ষা’, ’মুক্তি চাই’, ’লাভলেটার’, ’বীর সন্তান’, ’মিথ্যার মৃত্যু’, ’দোস্ত আমার দুশমন’, ’গৃহবধূ’, ’কে আমার বাবা’, ’রাজপথের রাজা’, ’শক্তের ভক্ত’, ’সুজনবন্ধু’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও ৯০ এর দশকের টেলিভিশন জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপস্থাপিকাও ছিলেন তিনি।